পল্লী কবী জসীম উদ্দীন-
জন্ম ও পারিবারিক পরিচিতি-
তিনি ১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে
জন্মগ্রহণ করেন।
তার
বাবার
বাড়ি
ছিল
একই
জেলার
গোবিন্দপুর গ্রামে। বাবার
নাম
আনসার
উদ্দিন
মোল্লা। তিনি
পেশায়
একজন
স্কুল
শিক্ষক
ছিলেন।
মা
আমিনা
খাতুন
ওরফে
রাঙাছুট।
শিক্ষাজীবন-
জসীম উদ্
দীন
ফরিদপুর ওয়েলফেয়ার স্কুল
ও পরবর্তীতে ফরিদপুর জেলা স্কুল (বর্তমানে ফরিদপুর জিলা স্কুল) পড়ালেখা করেন।
এখান
থেকে
তিনি
তার
প্রবেশিকা পরীক্ষায় ১৯২১
সনে
উত্তীর্ণ হন।
তিনি
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা
থেকে
বি.
এ. এবং এম. এ. শেষ করেন যথাক্রমে ১৯২৯
এবং
১৯৩১
সনে।[১]
কর্মজীবন-
১৯২৮ সালে
কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক
"কবর" কবিতা নির্বাচিত হওয়ার
পর
ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজে
জসীম
উদ্
দীন
(সনদ
হাতে)।
১৯৩১ থেকে
১৯৩৭
পর্যন্ত, দীনেশচন্দ্র সেনের
সাথে
লোক
সাহিত্য সংগ্রাহক হিসেবে
জসীম
উদ্
দীন
কাজ
করেন।
তিনি
পূর্ব বঙ্গ গীতিকার একজন সংগ্রাহকও। তিনি
১০,০০০ এরও বেশি
লোক
সংগীত
সংগ্রহ
করেছেন,
যার
কিছু
অংশ
তার
সংগীত
সংকলন
জারি গান এবং মুর্শিদা গান এ স্থান
পেয়েছে। তিনি
বাংলা
লোক
সাহিত্যের বিশদ
ব্যাখ্যা এবং
দর্শন
খণ্ড
আকারেও
লিখে
গেছেন।
১৯৩৩ সনে
তিনি
কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. দীনেশচন্দ্র সেনের অধীনে
রামতনু
লাহিড়ী গবেষণা
সহকারী
পদে
যোগ
দেন।
এরপর
১৯৩৮
সনে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা
বিভাগের প্রভাষক হিসেবে
যোগ
দেন।
তিনি
১৯৪৪
সালে
বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে
এবং
তথ্য ও সম্প্রচার বিভাগে যোগ দেন। ১৯৬২
সালে
অবসর গ্রহণের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি
ডেপুটি
ডিরেক্টর হিসেবে
কাজ
করে
গেছেন।
তিনি
গুরু
মৃত্যুন জয়
সিলের
কাছে
গুণগ্রাহী ছিলেন।[১] ১৯৬৯
সনে
রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে
সম্মান
সূচক
ডি
লিট
উপাধিতে ভূষিত
করেন।
মৃত্যু-
তিনি ১৩
মার্চ
১৯৭৬
সনে
ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর শেষ
ইচ্ছা
অনুসারে তাঁকে
ফরিদপুর জেলার
আম্বিকাপুর গ্রামে
তাঁর
দাদীর
কবরের
পাশে
দাফন
করা
হয়।[৪] গোবিন্দপুরে প্রতিবছর জানুয়ারি মাসে
তার
জন্মদিনকে স্মরণ
করে
জসীম মেলা নামে একটি পাক্ষিক উৎসব
উদযাপন
করা
হয়।[৫] তার
নামে
ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি
আবাসিক
হলের
নামকরণ
করা
হয়েছে।
কাব্য-
জসীম উদ্
দীন
একদম
অল্প
বয়স
থেকেই
লেখালেখি শুরু
করেন।
কলেজে
অধ্যয়নরত থাকা
অবস্থায়, পরিবার
এবং
বিয়োগান্ত দৃশ্যে,
একদম
সাবলীল
ভাষায়
তিনি
বিশেষ
আলোচিত
কবিতা
কবর লিখেন।
তিনি
কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র
থাকাবস্থায় এই
কবিতাটি প্রবেশিকার বাংলা পাঠ্যবইয়ে স্থান পায়।
গাঁয়ের লোকের
দৃষ্টিতে গ্রাম্য জীবন
এবং
পরিবেশ-প্রকৃতি ফুটিয়ে তোলার জন্য জসীম
উদ্
দীন
বিশেষভাবে পরিচিত। তার
এই
সুখ্যাতি তাকে
পল্লি কবি উপাধি এনে দিয়েছে। তার
কাব্যের গঠনপ্রণালী এবং
বিষয়বস্তু পাঠককে
বাংলা লোক সাহিত্যের প্রগাঢ় আস্বাদন এনে
দেয়।
তার
রচিত
নকশী কাঁথার মাঠ কাব্যগ্রন্থকে তার
শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম হিসেবে
বিবেচনা করা
হয়
এবং
পৃথিবীর অনেক ভাষায় এটি অনূদিত হয়েছে।
এছাড়াও জসীম
উদ্
দীন
গ্রাম
বাংলার
ঐতিহ্যবাহী অনেক
গান
রচনা
করেছেন। বাংলার
বিখ্যাত লোক
সংগীতের গায়ক,
আব্বাসউদ্দীন, তার
সহযোগিতায়[৬] কিছু
অবিস্মরণীয় লোকগীতি নির্মাণ করেছেন,
বিশেষত
ভাটিয়ালী ধারার।
জসীম
উদ্
দীন
রেডিওর
জন্যেও
আধুনিক
গান
লিখেছেন। তিনি
তার
প্রতিবেশী, কবি
গোলাম মোস্তফার দ্বারা
ইসলামিক সংগীত
লিখতেও
প্রভাবিত হয়েছিলেন। পরবর্তীতে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে,
তিনি
বহু
দেশাত্মবোধক গান
লিখেন।
গ্রন্থাবলি-
কাব্যগ্রন্থ
- রাখালী (১৯২৭)
- নকশী কাঁথার মাঠ (১৯২৯)
- বালুচর (১৯৩০)
- ধানখেত (১৯৩৩)
- সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৪)
- হাসু (১৯৩৮)
- রঙিলা নায়ের মাঝি(১৯৩৫)
- রুপবতি (১৯৪৬)
- মাটির কান্না (১৯৫১)
- এক পয়সার বাঁশী (১৯৫৬)
- সকিনা (১৯৫৯)
- সুচয়নী (১৯৬১)
- ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে (১৯৬২)
- মা যে জননী কান্দে (১৯৬৩)
- হলুদ বরণী (১৯৬৬)
- জলে লেখন (১৯৬৯)
- কাফনের মিছিল ((১৯৮৮)
- কবর
নাটক-
- পদ্মাপার (১৯৫০)
- বেদের মেয়ে (১৯৫১)
- মধুমালা (১৯৫১)
- পল্লীবধূ (১৯৫৬)
- গ্রামের মেয়ে (১৯৫৯)
- ওগো পুস্পধনু (১৯৬৮)
- আসমান সিংহ (১৯৮৬)
আত্মকথা-
- যাদের দেখেছি ((১৯৫১)
- ঠাকুর বাড়ির আঙ্গিনায় (১৯৬১)
- জীবন কথা ( ১৯৬৪)
- স্মৃতিপট (১৯৬৪)
উপন্যাস-
- বোবা কাহিনী (১৯৬৪)
ভ্রমণ কাহিনী-
- চলে মুসাফির (১৯৫২)
- হলদে পরির দেশে ( ১৯৬৭)
- যে দেশে মানুষ বড় (১৯৬৮)
- জার্মানীর শহরে বন্দরে] (১৯৭৫)
সঙ্গীত
- জারি গান (১৯৬৮)
- মুর্শিদী গান (১৯৭৭)
অন্যান্য
- বাঙালির হাসির গল্প
- ডালিমকুমার (১৯৮৬)
গানের শিরোনাম
- আমার সোনার ময়না পাখি
- আমার গলার হার খুলে নে
- আমার হার কালা করলাম রে
- আমায় ভাসাইলি রে
- আমায় এতো রাতে
- কেমন তোমার মাতা পিতা
- নদীর কূল নাই কিনার নাই
- ও বন্ধু রঙিলা
- রঙিলা নায়ের মাঝি
- নিশ্তে যাইও ফুলবাণে, ও ভোমরা
- ও বাজান চল যাই মাঠে লাঙল বাইতে
- প্রানো শখি রে ঐ শুনে কদম্ব তলে
- ও আমার দরদি আগে জানলে
- বাঁশরি আমার হারাই গিয়াছে
- বালু চরের মেয়া
- বাদল বাঁশি ওরে বন্ধু
- গাঙ্গের কূলরে গেলো ভাঙিয়া
- ও তুই যারে আঘাত হানলিরে মনে
- ও আমার গহীন গানের নায়া
- আমার বন্ধু বিনুধিয়া
পুরস্কার
- প্রেসিডেন্টস এওয়ার্ড ফর প্রাইড অফ পারফরমেন্স, পাকিস্তান (১৯৫৮)
- রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি. লিট ডিগ্রি, ভারত (১৯৬৯)
- ১৯৭৪ সনে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন
- একুশে পদক, বাংলাদেশ (১৯৭৬)
- স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার ১৯৭৮ (মরণোত্তর)
হুমায়ুন কবির- (১৯০৬-১৯৬৯) রাজনীতিবিদ, লেখক, দার্শনিক। ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার সেরা
ফসলরূপে গণ্য
যেসব
কর্মিপুরুষ পরবর্তীকালে স্বাধীন স্বদেশে বৌদ্ধিক ও প্রশাসনিক দিক নির্দেশনায় সফল
ভূমিকা
রেখেছেন, হুমায়ুন কবির
তাঁদের
অন্যতম। ১৯০৬
সালের
২২
ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর জেলার
কোমরপুর গ্রামে
তাঁর
জন্ম।
তাঁর
প্রকৃত
নাম
হুমায়ুন জহিরউদ্দিন আমির-ই-কবির। পিতা
কবিরউদ্দিন আহমদ
ছিলেন
ডেপুটি
ম্যাজিস্ট্রেট। হুমায়ুন কবিরের
পিতা
ও পিতামহ দুজনেই ব্রিটিশ সরকারের নিকট
থেকে
‘খান
বাহাদুর’ উপাধি
পেয়েছিলেন।
তিনি নওগাঁর কে.ডি স্কুল থেকে ম্যট্রিক (১৯২২) এবং কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট (১৯২৪) পরীক্ষায় পাস করেন। তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ইংরেজিতে অনার্সসহ এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। অধ্যয়ন শেষে সরকারি চাকরিতে না গিয়ে হুমায়ুন কবির শিক্ষকতার মানসে ১৯২৮ সালে বৃত্তি নিয়ে অক্সফোর্ড যান। সেখানে একসেটার কলেজে ‘মডার্ন গ্রেটস’ অর্থাৎ দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতিতে বিএ (অনার্স) পরীক্ষায়ও তিনি অসাধারণ ফলাফল অর্জন করেন। অধ্যয়নের পাশাপাশি তিনি নিজেকে একজন তুখোড় ছাত্রনেতা ও বাগ্মিরূপে প্রতিষ্ঠিত করেন।
১৯৩২ সালে রাধাকৃষ্ণনের আমন্ত্রণে হুমায়ুন কবির অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের প্রভাষকরূপে যোগদান করেন। এক বছর পরে তিনি চলে আসেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি সাহিত্যচর্চা ও ট্রেড ইউনিয়ন রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হকের কৃষক-প্রজা পার্টির পক্ষ থেকে তিনি দীর্ঘ দশ বছর (১৯৩৭-৪৭) বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য ছিলেন। তিনি ছিলেন কৃষক-শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষার একজন শক্তিশালী প্রবক্তা। ভারতের তিনটি বড় বড় ট্রেড ইউনিয়নের তিনি সভাপতি ছিলেন।
১৯৪৬ সালে হুমায়ুন কবির কংগ্রেস সভাপতি মাওলানা আবুল কালাম আজাদএর আমন্ত্রণে তাঁর একান্ত সচিবরূপে যোগদান করেন। পরে ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানে মাওলানা শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালে তিনি পর্যায়ক্রমে যুগ্ম শিক্ষা উপদেষ্টা, শিক্ষাসচিব ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত হন। ১৯৫৬ সালে তিনি ভারতীয় রাজ্যসভার সদস্য নির্বাচিত হন। প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু তাঁকে কেন্দ্রীয় সিভিল এভিয়েশনের প্রতিমন্ত্রী নিযুক্ত করেন এবং ১৯৫৮ সালে মাওলানা আজাদের মৃত্যুর পর তাঁকে শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। এরপর তিনি বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিযুক্ত হন। ১৯৫৭ থেকে ১৯৬৯ সালে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি পশ্চিমবঙ্গের বশির হাট থেকে লোকসভার নির্বাচিত সদস্য ছিলেন।
নেহেরুর মৃত্যুর পর লালবাহাদুর শাস্ত্রীর প্রধান মন্ত্রিত্বের সময় হুমায়ুন কবির পুনরায় শিক্ষামন্ত্রীর পদ লাভ করেন। শাস্ত্রীর মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে মাদ্রাজের গভর্নর-পদ দিতে চাইলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। লোকসভার সদস্য-পদ এবং কংগ্রেস দল ত্যাগ করে বাংলা কংগ্রেস পার্টি গঠন তাঁর পরবর্তী চার বছরের রাজনৈতিক কর্মকান্ড। কেন্দ্রীয় কংগ্রেস নিয়ন্ত্রিত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পতন ঘটিয়ে একটি যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠনে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা ছিল (১৯৬৭)। হুমায়ুন কবিরের রাজনৈতিক জীবনে ভারতের শিক্ষা ও সংস্কৃতি নীতি চূড়ান্তরূপ লাভ করে।
জীবনের প্রতিটি পদচারণায় হুমায়ুন কবির সাফল্য অর্জন করেছেন। তাঁর সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য। লেখার জগতে প্রবেশ করে তিনি এক আকর্ষণীয় ভাষাভঙ্গি আয়ত্ত করেন। লেখকরূপে আত্মপ্রকাশের আগে তিনি বেশ কিছুদিন সম্পাদনার কাজ করেন। নওগাঁ কে.ডি হাইস্কুলের ম্যাগাজিন (১৯২০), প্রেসিডেন্সি কলেজ ম্যাগাজিন (১৯২৬), অক্সফোর্ডে Sis ও Cherwell নামক দুটি পত্রিকা এবং অক্সফোর্ড থেকে দেশে ফিরে ১৯৩২ সালে বারোমাসি নামে একটি মাসিক পত্রিকা তিনি সম্পাদনা করেন। তবে বাংলা সাময়িক পত্রের ইতিহাসে তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন তাঁর সম্পাদিত অতি উঁচুমানের চতুরঙ্গ (১৯৩৯-৬৯) ত্রৈমাসিকের জন্য। এছাড়া দেশি-বিদেশি বহু প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে তিনি রিপোর্ট ও গ্রন্থাদি সম্পাদনা করেছেন। এ প্রসঙ্গে ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত বাংলা গল্প ও কবিতার সংকলন গ্রীণ এ্যান্ড গোল্ড বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
সাহিত্যক্ষেত্রে প্রথমত কবি হিসেবেই হুমায়ুন কবিরের আত্মপ্রকাশ ঘটে। তিনটি কাব্যগ্রন্থ স্বপ্নসাধ (১৯২৮), সাথী (১৯৩০) ও অষ্টাদশী (১৯৩৮) প্রকৃতি ও প্রেমবিষয়ক তাঁর স্বচ্ছ রোম্যান্টিক মানসের পরিচয় বহন করে। বন্ধুদের মতো ইউরোপীয় ধারার আধুনিকতার চর্চা না করে তিনি কাব্যক্ষেত্রে রবীন্দ্র ঐতিহ্যের অনুসরণ করেন। ১৯৪৩ সালে উর্দু থেকে মসদ্দসে হার্লী-র বাংলা অনুবাদ তাঁর অন্যতম কৃতিত্ব।
খুবই সংক্ষিপ্ত হলেও হুমায়ুন কবিরকে কথাসাহিত্যের জগতেও অনুশীলনব্রতী হতে দেখা যায়। তিরিশের দশকে তাঁর লেখা কয়েকটি ছোটগল্প স্বনামে ও বেনামে প্রকাশিত হয়। ১৯৪৫ সালে তাঁর নদী ও নারী উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় এবং একই বছর Men and Rivers নামে এর একটি ইংরেজি সংস্করণও প্রকাশিত হয়। এ উপন্যাসে কবির পদ্মানদীর পরিবেশে বাঙালি মুসলমান সমাজজীবনের একটি নিখুঁত চিত্র উপস্থাপন করেছেন। ১৯৬৫ সালে ঢাকায় উপন্যাসটি চলচ্চিত্রায়িত হয়।
একথা অবশ্য স্বীকার্য যে, হুমায়ুন কবিরের প্রধান পরিচিতি একজন প্রবন্ধকাররূপে। ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষায় তিনি দর্শন, সাহিত্য, শিক্ষানীতি ও সমাজতত্ত্ব বিষয়ে মৌলিক প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তাঁর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো: ইমানুয়েল কান্ট (১৯৩৬), শরৎ সাহিত্যের মূলতত্ত্ব (১৯৪২), বাংলার কাব্য (১৯৪৫), মার্কসবাদ (১৯৫১), নয়া ভারতের শিক্ষা (১৯৫৫), শিক্ষক ও শিক্ষার্থী (১৯৫৭), মিরজা আবু তালিব খান (১৯৬১),
দিল্লী-ওয়াশিংটন-মস্কো (১৯৬৪), Kant on Philosophy in General (১৯৩৫), Poetry, Monads and Society (১৯৪১), Muslim Politics in Bengal (১৯৪৩), Rabindranath Tagore (১৯৪৫), The Indian Heritage (১৯৪৬, ১৯৬০), Science, Democracy and Islam (১৯৫৫), Education in
India (১৯৫৬), Studies in Bengali Poetry (১৯৬৪), The Bengali Novel (১৯৬৮), Education for Tomorrow (১৯৬৮), Minorities in Democracy (১৯৬৯) ইত্যাদি। প্রথম জীবনে হুমায়ুন কয়েকটি নাটকও রচনা করেছিলেন যেগুলি অভিনীত হয়েছিল, কিন্তু মুদ্রিত হয় নি। তাঁর রচিত গ্রন্থসংখ্যা মোট ৪৫।
বক্তারূপে বিশেষ সুনামের অধিকারী হুমায়ুন কবির দেশে-বিদেশে বহু বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণ পেয়েছেন। অক্সফোর্ডে আইনস্টাইন ও রাসেলের ওপর তিনি হার্বার্ট স্পেন্সার বক্তৃতা দিয়েছেন। এ কাজে এশীয়দের মধ্যে তিনিই প্রথম। ১৯৫৭ সালে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী আহূত কাগমারি সম্মেলনে তিনি ভারতীয় প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন। সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি আলীগড় (১৯৫৮), আন্নামালাই (১৯৫৯), খয়রাগড় (মধ্যপ্রদেশ, ১৯৬১), বিশ্বভারতী, মহীশূর ও এথেন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডি.লিট বা সমপর্যায়ের ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৯ সালের ১৮ আগস্ট হূদরোগে তাঁর মৃত্যু হয়। [মাহমুদ শাহ কোরেশী]
No comments:
Post a Comment