দেশীয় রাজন্যদের বিদ্রোহ যখন
স্তিমিত, সমগ্র
দেশ
ব্রিটিশের করতলগত,
তখনই
সংগঠিত
হয়
ফকির
বা
সন্ন্যাসী বিদ্রোহ। ১৭৭২
থেকে
১৭৭৬
পর্যন্ত বঙ্গদেশে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফকির
বা
সন্ন্যাসী বিদ্রোহ পরিচালিত হয়।
ফকির
ও সন্ন্যাসীদের প্রধান কর্মক্ষেত্র উত্তরবঙ্গে থাকলেও
পরবর্তীকালে তারা
পূর্ববঙ্গে ছড়িয়ে
পড়েছিল। পূর্ববঙ্গে তাদের
কর্মকান্ডের উল্লেখযোগ্য ইতিহাস
পাওয়া
যায়
না।
ফরিদপুরের মাদারীপুর ও গোয়ালন্দ মহকুমায় ফকির সন্ন্যাসীদের কিছু
আখড়া
ছিল
বলে
জানা
যায়।
এ জেলায় সন্ন্যাসীদের কেউ
কেউ
বসতি
স্থাপন
করেছিল। এরা
গিরি
গোসাই
বলে
পরিচিত। ফরিদপুরের বেলগাছির রথখোলা এদেরই
অন্যতম
আখড়া।
১৮৩১ সালে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সৈয়দ নিসার আলী তিতুমীর কলকাতার নারিকেলবাড়িতে বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সাহসী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। চব্বিশ পরগনা, নদীয়, ফরিদপুর অঞ্চল ছিল তিতুমীরের প্রভাবিত এলাকা। এসব জেলা থেকে দলে দলে লোক তার মুজাহিদ বাহিনীতে যোগ দেন। চূড়ান্ত শক্তি পরীক্ষায় তিতুমীর ও তার সহচররা আত্মোত্সর্গ করেন। তাদের এ সাহসী আত্মদান আমাদের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। ১৮৩৩ সালে ব্রিটিশ সরকার নতুন বিধি জারি করে। তাতে ইউরোপীয়রা এদেশে জমি ক্রয় করার অধিকার প্রাপ্ত হন। ইংরেজ ও দেশীয় জমিদাররা ফরিদপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নীলকুঠি স্থাপন করে। নীলকুঠিয়ালদের মধ্যে ইংরেজরাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী, আলফাডাঙ্গা, নগরকান্দাসহ বিভিন্ন স্থানে ব্যাপকভাবে নীলচাষ শুরু হয়। সেই সঙ্গে শুরু হল জবরদস্তিমূলকভাবে জমি দখলসহ চাষীদের উপর নির্মম নির্যাতন। এই নির্যাতনের কাহিনী বর্ণিত রয়েছে সমসাময়িক পত্রপত্রিকা, নাটক ও কথাসাহিত্যে। এ প্রসঙ্গে শিশির কুমারের বর্ণনায় বাংলার লাট গ্রান্ট সাহেবের কাছে কৃষক প্রজা ফড়িয়াদের একটি চিত্র পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন, 'নীল বিদ্রোহের সময় মুসলমান প্রজারা কি সাহস, ধৈর্য ও অধ্যবসায় দেখায়। সেবার অবিচলিত চিত্তে তাহারা কিনা সহ্য করে। গড়াই নদীর এখন অত্যন্ত দুর্দশা । যখন নীলের গোলমাল হয়, তখন গড়াই পদ্মার ন্যায় বেগবতী ছিল। 'লে. গভর্নর গ্রান্ট এই গড়াই নদীর মধ্য দিয়া স্টিমার যোগে গমন করিতেছেন। নদীর দুই ধারে সহস্র সহস্র প্রজা হাতে দরখাস্ত লইয়া ক্যাপ্টেনকে জাহাজ লাগাইতে বলিতে লাগিল। লে. কোনমতে জাহাজ নদীর তীরে লাগাইলেন না। শত শত প্রজা নদীতে লম্ফ প্রদান করিল। গড়াই মহাবেগ গণ্য করিলো না। তখন তাহারা নীলকরের অত্যাচার হইতে তাহাদিগকে রক্ষা করিতে সংকল্প করিয়াছে। তাহার নিমিত্ত তাহাদের প্রাণ-সংকল্প। প্রজাদের লম্ফ প্রদান করিতে দেখিয়া লে. গভর্নর জাহাজ লাগাইতে বাধ্য হইলেন। প্রজারা জাহাজ ঘিরিয়া ফেলিল। এবং গ্রান্ট সাহেবকে প্রতিজ্ঞা করাইয়া লইল যে, তিনি তাহাদের রক্ষা করিবেন।' গ্রান্ট সাহেবের প্রতিজ্ঞায় কোন ফল দিল না। বরং নির্যাতনের মাত্রা দিনকে দিন বেড়েই চলল। তার বিরুদ্ধে অধিকার আদায়ের দৃপ্ত শপথে শুরু হল নীল বিদ্রোহ। ধর্মঘট ও সশস্ত্র প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠে। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে এই আন্দোলনে শরিক হয়। মীর মোশাররফ হোসেনের 'নীল দর্পণ' নাটকে বিদ্রোহী প্রজাদের জীবনালেখ্য বিবৃত রয়েছে।
হাজী শরীয়তুল্লাহ কর্তৃক ধর্মীয় আন্দোলন হিসেবে ফরায়েজী আন্দোলন শুরু হলেও তার পুত্র দুদু মিয়ার নেতৃত্বে তা রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নেয়। ফরায়েজী আন্দোলন জমিদার, নীলকর ও ইংরেজ শাসকের বিরুদ্ধে প্রজা কৃষকদের আন্দোলন হিসেবে বেগবান হয়ে ওঠে। আঠার শতকের ৪০ ও ৫০ এর দশক জুড়ে ফরিদপুর, ঢাকাসহ কতিপয় জেলায় এ আন্দোলন পরিচালিত হয়। প্রজাদের বেশিরভাগ মুসলমান, জমিদাররা হিন্দু ও নীলকররা ইংরেজ। তাই ধর্মীয় আবেগ ও মুক্তির আকঙ্ক্ষা দুই ধারণ করে প্রজাকুল। জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীরা সংঘর্ষে অবতীর্ণ হয়। এ আন্দোলনে হাজার হাজার কৃষক আংশগ্রহণ করে। তারা ফরিদপুরের বহু নীলকরদের কুঠি ও জমিদারের কাচারিতে আক্রমণ করে। ফরায়েজীরা জমিদারদের খাজনা না দেয়ার জন্যও জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে। উনিশ শতকের প্রথম দশকে বাংলায় অগ্নীযুগের বিপ্লবীরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফরিদপুরে বিভিন্ন তত্পরতা লক্ষ করা যায়। মাদারীপুর ছিল আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ বিন্দু। ফরিদপুর শহরের নিবারণ পাল, রমেশ দাস গুপ্ত, যদুপাল, তারপদ লাহিড়ী, দীনেশ দাস গুপ্ত, মাদারীপুরের বিলাসখান গ্রামের আশুতোষ কাহিলী, জীবন ঠাকুরতা, নলিনী ভট্টাচার্য, চিত্ত কাহিলী, ধীরেন আতর্থী, সুবোধ রায়, কোয়ারপুরের কেদারেশ্বর সেন গুপ্ত, ফতেজংপুরের ধীরেন চট্টোপধ্যায়, শলেদাহের ধীনেশ বিশ্বাস, আশু চক্রবর্তী, ভুবন বসু, পালং এর সচীন কর, প্রমদ গুহ, প্রমদ সরকার ছিলেন অনুশীলন সমিতির নেতৃস্থানীয় সংগঠক। ফরিদপুর জেলায় যুগান্তরের নেতৃত্বে ছিলেন মাদারীপুরের পূর্ণ চন্দ দাস। বিদ্রোহী কাজী নজরুল ইসলাম বিপ্লবী পূর্ণদাসকে তার 'সন্ধ্যা' কবিতা গ্রন্থটি উত্সর্গ করেন। বিপ্লবী রাজনীতি যখন তুঙ্গে, তখন ফরিদপুরের অম্বিকা চরণ মজুমদারের নেতৃত্বে গঠিত হয় ফরিদপুর পিপলস এ্যাসোসিয়েশন। কংগ্রেসের ৪ বছর আগে ১৮৮১ সালে গঠিত এ সংগঠনটি সম্ভবত পূর্ববঙ্গের প্রথম রাজনৈতিক সংগঠন।
১৯০৫ সালে জানুয়ারিতে ফরিদপুরে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে অম্বিকাচরণ মজুমদারের সভাপতিত্বে প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। এবং প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয়। তাতে ছিলেন মথুরানাথ মৈত্র, পূর্ণ মৈত্র , জগবন্ধু মৈত্র, সতীশ মজুমদার, উমাচরণ আচার্য ও আসাদুজ্জামান। পরবর্তীকালে সুরেশ চন্দ বন্দ্যোপধ্যায় আপসহীন নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ফরিদপুরের মুসলমানদের অনেকেই বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে শরীক হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে, পাংশার আসাদুজ্জামন, কহিনুর সম্পাদক রওশন আলী চৌধুরী, মৌলবী আব্দুর রহমান দুদু মিয়া ও মাদারীপুরের গোলাম মাওলা চৌধুরী উল্লেখযোগ্য।
অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলন যুগপত্ভাবে শুরু হলে হিন্দু-মুসলমান একযোগে আন্দোলনে ঝঁপিয়ে পরে। তখন ব্যাপকভাবে নেতারা ফরিদপুরে কারারুদ্ধ হন। তাদের মধ্যে ছিলেন, অম্বিকা চরণ মজুমদার, নিবারণ পাল, যদুপাল, ভুপেন দত্ত, পর্ণ দাস, প্রতাব গুহ রায়, সুরেষ দাস, সুরেষ ব্যানার্জী, তমিজউদ্দিন খান, পীর বাদশা মিয়া, লাল মিয়া, হাজী নয়ন শরীফ, সরকার দুর্গা শংকর বসু, যতীন ভট্টাচার্য, গোলাম গফুর চৌধুরী, শরত্ চন্দ রায় চৌধুরী প্রমুখ। ছাত্র সমাজ ব্যাপকভাবে স্বদেশি আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। 'ছাত্রদের আন্দোলনে অংশ গ্রহণের জন্য অন্যান্য স্কুলের সঙ্গে ফরিদপুরের ঈশান ইন্সটিউিটসহ বৃহত্তর ফরিদপুরের কয়েকটি স্কুলের কর্তৃপক্ষকে কড়া ভাষায় কৈফিয়ত ও মুচলেকা দাবি করা হয়।'
স্বদেশি পটভূমিতে ১৯২৪ সালে ফরিদপুর শহরের টেপাখোলাস্থ খেলার মাঠে বঙ্গীয় কংগ্রেসের সম্বেলন দেশবন্ধু চিত্ত রঞ্জন দাসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী সুভাষ চন্দ বসু, সরোজনী নাইডু, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ যোগ দেন। ওই সম্মেলনে বিদ্রাহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম নিজের লেখা সঙ্গীত পরিবেশন করেন।
বিশ ও ত্রিশ দশকের বৃহত্তর ফরিদপুরের নেতাদের মধ্যে ছিলেন আশু ভরদ্বাজ, সত্য মৈত্র, শান্তি সেন, সমর সিংহ প্রমুখ। যাদের নেতৃত্বে পরবর্তীতে ফরিদপুরে কমিউনিস্ট পার্টির গোড়াপত্তন হয়।
১৯৩০ সালে লবণ সত্যগ্রহ আন্দোলন তীব্র রূপ লাভ করে।ফরিদপুরে প্রায় দুই হাজার লোককে কারারুদ্ধ করা হয়। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন ফরিদপুর শহরের চৌধুরী মোয়াজ্জেম হোসেন লাল মিয়া, রাজবাড়ীর মিসেস চারুপ্রভা সেন, সোনাপুরের নরেশ ঘোষ, প্রভাষ ঘোষ, ক্রোকদীর অনিল লাহিড়ী, অমল স্যানাল, শ্যামেন ভট্টাচার্য, মাদারীপুরের শান্তি সেন, বাহাদুর পুরের পীর বাদশা মিয়া।
ফরিদপুরের বর্তমান আলফাডাঙ্গা, বোয়ালমারী , বালিয়াকান্দিতে তেভাগা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল। যার নেতৃত্বে ছিলেন কমিউনিস্ট নেতা সত্য মৈত্র, শ্যামেন ভট্টাচার্যসহ অন্য নেতারা। শেরে বাংলার নেতৃত্বে গঠিত কৃষক প্রজা পার্টি কৃষকদের সংগঠিত করে জমিদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে আন্দোলন পরিচলনা করে। ফরিদপুরে নেতৃত্বে ছিলেন, পীর বাদশা মিয়া, হুমায়ূন কবীর, জাহাঙ্গীর কবীর, একেএম আব্দুল হাকীম, মোজাহার চোকদার, এমএ ওয়াহিদ প্রমুখ। একসময় মৌলবী তমিজউদ্দিন খান ( এককালীন কংগ্রেস ও পরে মুসলিম লীগ নেতা ) কৃষক সমিতির আন্দোলনে ভূমিকা পালন করেন।
১৯৪২ সালে ফরিদপুর দেউলীতে ফরিদপুর জেলা কৃষক প্রজা পার্টির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় । এতে যোগ দিয়েছিলেন কমরেড এমএন রায়, সৈয়দ নওশের আলী, শামসুদ্দিন আহম্মেদ, হাসেম আলী খান, উপেন্দ নাথ বর্মণ, হুমায়ূন কবীর ও জাহাঙ্গীর কবীর।
ভারত ছাড় আন্দোলনে ১৯৪২ সালে ১৯ সেপ্টেম্বর ভাঙ্গায় মিছিলে বাধা দিলে মিছিলকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। এতে 'রাহিনী বাবু' নামক পুলিশ সাব ইন্সপেক্টর নিহত এবং দুইজন সিপাহী আহত হয়। ওই ঘটনার জের হিসেবে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কিছু স্থানীয় লোককে উস্কানি দিয়ে স্বদেশিদের বাড়ি ও দোকান লুটপাট করায় এবং স্বদেশিদের ১৫ হাজার টাকা জরিমানাও করে। ভারত ছাড় আন্দোলন তত্কালীন ফরিদপুর জেলায় ব্যাপক রূপ লাভ করে। সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় দেড় শতাধিক লোককে গ্রেফতার এবং সুরেষ ব্যানার্জীসহ ৩৩ জনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মেয়াদী শাস্তি প্রদান করা হয়। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ছিলেন ফরিদপুর শহরের টেপাখোলার বিজলী দাস গুপ্ত, থানা রোডের সুনীল চন্দ ব্যানার্জী, পালং এর রায় হারান সেন, মুকসুদপুরের ননী গোপাল ভট্টাচার্য, রাজবাড়ীর নিরোধবন্ধু দাস ও নরেশ চন্দ বসু। আন্দোলনকারীরা ফরিদপুরে দুইটি স্থানের টেলিফোন লাইন বিছিন্ন করে এবং জেলা স্কুলে আগুন লাগিয়ে দেয়। বর্তমান শরীয়তপুরের নড়িয়ায় ড. সুরেষ ব্যানার্জী এমএলএ এর গ্রেফতার প্রতিরোধে নারীরা এগিয়ে গেলে তারা পুলিশের হাতে লাঞ্ছিত হয়।
৪৬ সালে বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখা দিলে ফরিদপুরের কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, কমিউনিস্ট নেতারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে। ৪৬ সালে নোয়াখালী হতে ফেরার পথে গোয়ালন্দ ঘাটে মহাত্মা গান্ধীকে হাজার হাজার জনতা অভ্যর্থনা জানায়।
৪০ এর দশকে হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব বেড়ে যায়। মুসলমানরা কংগ্রেস ও কৃষক প্রজা পার্টি ত্যাগ করে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে মুসলিম লীগের পতাকাতলে শামিল হয়। ফরিদপুরে পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন তমিজউদ্দিন খান, ইউসুফ আলী চৌধুরী মোহন মিয়া, আব্দুস সালাম খান, যুব নেতা শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ।
ফরিদপুরে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্র নির্মাণ করেছিল শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন। শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ফরিদপুরের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। প্রখ্যাত কংগ্রেস নেতা অম্বিকাচরণ মজুমদারের নেতৃত্বে ১৯১৮ সালে রাজেন্দ কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। কলেজটি ফরিদপুরের রাজনৈতিক আন্দোলনের অন্যতম সূতিকাগার।
১৮৩১ সালে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সৈয়দ নিসার আলী তিতুমীর কলকাতার নারিকেলবাড়িতে বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সাহসী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। চব্বিশ পরগনা, নদীয়, ফরিদপুর অঞ্চল ছিল তিতুমীরের প্রভাবিত এলাকা। এসব জেলা থেকে দলে দলে লোক তার মুজাহিদ বাহিনীতে যোগ দেন। চূড়ান্ত শক্তি পরীক্ষায় তিতুমীর ও তার সহচররা আত্মোত্সর্গ করেন। তাদের এ সাহসী আত্মদান আমাদের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। ১৮৩৩ সালে ব্রিটিশ সরকার নতুন বিধি জারি করে। তাতে ইউরোপীয়রা এদেশে জমি ক্রয় করার অধিকার প্রাপ্ত হন। ইংরেজ ও দেশীয় জমিদাররা ফরিদপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নীলকুঠি স্থাপন করে। নীলকুঠিয়ালদের মধ্যে ইংরেজরাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী, আলফাডাঙ্গা, নগরকান্দাসহ বিভিন্ন স্থানে ব্যাপকভাবে নীলচাষ শুরু হয়। সেই সঙ্গে শুরু হল জবরদস্তিমূলকভাবে জমি দখলসহ চাষীদের উপর নির্মম নির্যাতন। এই নির্যাতনের কাহিনী বর্ণিত রয়েছে সমসাময়িক পত্রপত্রিকা, নাটক ও কথাসাহিত্যে। এ প্রসঙ্গে শিশির কুমারের বর্ণনায় বাংলার লাট গ্রান্ট সাহেবের কাছে কৃষক প্রজা ফড়িয়াদের একটি চিত্র পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন, 'নীল বিদ্রোহের সময় মুসলমান প্রজারা কি সাহস, ধৈর্য ও অধ্যবসায় দেখায়। সেবার অবিচলিত চিত্তে তাহারা কিনা সহ্য করে। গড়াই নদীর এখন অত্যন্ত দুর্দশা । যখন নীলের গোলমাল হয়, তখন গড়াই পদ্মার ন্যায় বেগবতী ছিল। 'লে. গভর্নর গ্রান্ট এই গড়াই নদীর মধ্য দিয়া স্টিমার যোগে গমন করিতেছেন। নদীর দুই ধারে সহস্র সহস্র প্রজা হাতে দরখাস্ত লইয়া ক্যাপ্টেনকে জাহাজ লাগাইতে বলিতে লাগিল। লে. কোনমতে জাহাজ নদীর তীরে লাগাইলেন না। শত শত প্রজা নদীতে লম্ফ প্রদান করিল। গড়াই মহাবেগ গণ্য করিলো না। তখন তাহারা নীলকরের অত্যাচার হইতে তাহাদিগকে রক্ষা করিতে সংকল্প করিয়াছে। তাহার নিমিত্ত তাহাদের প্রাণ-সংকল্প। প্রজাদের লম্ফ প্রদান করিতে দেখিয়া লে. গভর্নর জাহাজ লাগাইতে বাধ্য হইলেন। প্রজারা জাহাজ ঘিরিয়া ফেলিল। এবং গ্রান্ট সাহেবকে প্রতিজ্ঞা করাইয়া লইল যে, তিনি তাহাদের রক্ষা করিবেন।' গ্রান্ট সাহেবের প্রতিজ্ঞায় কোন ফল দিল না। বরং নির্যাতনের মাত্রা দিনকে দিন বেড়েই চলল। তার বিরুদ্ধে অধিকার আদায়ের দৃপ্ত শপথে শুরু হল নীল বিদ্রোহ। ধর্মঘট ও সশস্ত্র প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠে। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে এই আন্দোলনে শরিক হয়। মীর মোশাররফ হোসেনের 'নীল দর্পণ' নাটকে বিদ্রোহী প্রজাদের জীবনালেখ্য বিবৃত রয়েছে।
হাজী শরীয়তুল্লাহ কর্তৃক ধর্মীয় আন্দোলন হিসেবে ফরায়েজী আন্দোলন শুরু হলেও তার পুত্র দুদু মিয়ার নেতৃত্বে তা রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নেয়। ফরায়েজী আন্দোলন জমিদার, নীলকর ও ইংরেজ শাসকের বিরুদ্ধে প্রজা কৃষকদের আন্দোলন হিসেবে বেগবান হয়ে ওঠে। আঠার শতকের ৪০ ও ৫০ এর দশক জুড়ে ফরিদপুর, ঢাকাসহ কতিপয় জেলায় এ আন্দোলন পরিচালিত হয়। প্রজাদের বেশিরভাগ মুসলমান, জমিদাররা হিন্দু ও নীলকররা ইংরেজ। তাই ধর্মীয় আবেগ ও মুক্তির আকঙ্ক্ষা দুই ধারণ করে প্রজাকুল। জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীরা সংঘর্ষে অবতীর্ণ হয়। এ আন্দোলনে হাজার হাজার কৃষক আংশগ্রহণ করে। তারা ফরিদপুরের বহু নীলকরদের কুঠি ও জমিদারের কাচারিতে আক্রমণ করে। ফরায়েজীরা জমিদারদের খাজনা না দেয়ার জন্যও জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে। উনিশ শতকের প্রথম দশকে বাংলায় অগ্নীযুগের বিপ্লবীরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফরিদপুরে বিভিন্ন তত্পরতা লক্ষ করা যায়। মাদারীপুর ছিল আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ বিন্দু। ফরিদপুর শহরের নিবারণ পাল, রমেশ দাস গুপ্ত, যদুপাল, তারপদ লাহিড়ী, দীনেশ দাস গুপ্ত, মাদারীপুরের বিলাসখান গ্রামের আশুতোষ কাহিলী, জীবন ঠাকুরতা, নলিনী ভট্টাচার্য, চিত্ত কাহিলী, ধীরেন আতর্থী, সুবোধ রায়, কোয়ারপুরের কেদারেশ্বর সেন গুপ্ত, ফতেজংপুরের ধীরেন চট্টোপধ্যায়, শলেদাহের ধীনেশ বিশ্বাস, আশু চক্রবর্তী, ভুবন বসু, পালং এর সচীন কর, প্রমদ গুহ, প্রমদ সরকার ছিলেন অনুশীলন সমিতির নেতৃস্থানীয় সংগঠক। ফরিদপুর জেলায় যুগান্তরের নেতৃত্বে ছিলেন মাদারীপুরের পূর্ণ চন্দ দাস। বিদ্রোহী কাজী নজরুল ইসলাম বিপ্লবী পূর্ণদাসকে তার 'সন্ধ্যা' কবিতা গ্রন্থটি উত্সর্গ করেন। বিপ্লবী রাজনীতি যখন তুঙ্গে, তখন ফরিদপুরের অম্বিকা চরণ মজুমদারের নেতৃত্বে গঠিত হয় ফরিদপুর পিপলস এ্যাসোসিয়েশন। কংগ্রেসের ৪ বছর আগে ১৮৮১ সালে গঠিত এ সংগঠনটি সম্ভবত পূর্ববঙ্গের প্রথম রাজনৈতিক সংগঠন।
১৯০৫ সালে জানুয়ারিতে ফরিদপুরে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে অম্বিকাচরণ মজুমদারের সভাপতিত্বে প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। এবং প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয়। তাতে ছিলেন মথুরানাথ মৈত্র, পূর্ণ মৈত্র , জগবন্ধু মৈত্র, সতীশ মজুমদার, উমাচরণ আচার্য ও আসাদুজ্জামান। পরবর্তীকালে সুরেশ চন্দ বন্দ্যোপধ্যায় আপসহীন নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ফরিদপুরের মুসলমানদের অনেকেই বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে শরীক হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে, পাংশার আসাদুজ্জামন, কহিনুর সম্পাদক রওশন আলী চৌধুরী, মৌলবী আব্দুর রহমান দুদু মিয়া ও মাদারীপুরের গোলাম মাওলা চৌধুরী উল্লেখযোগ্য।
অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলন যুগপত্ভাবে শুরু হলে হিন্দু-মুসলমান একযোগে আন্দোলনে ঝঁপিয়ে পরে। তখন ব্যাপকভাবে নেতারা ফরিদপুরে কারারুদ্ধ হন। তাদের মধ্যে ছিলেন, অম্বিকা চরণ মজুমদার, নিবারণ পাল, যদুপাল, ভুপেন দত্ত, পর্ণ দাস, প্রতাব গুহ রায়, সুরেষ দাস, সুরেষ ব্যানার্জী, তমিজউদ্দিন খান, পীর বাদশা মিয়া, লাল মিয়া, হাজী নয়ন শরীফ, সরকার দুর্গা শংকর বসু, যতীন ভট্টাচার্য, গোলাম গফুর চৌধুরী, শরত্ চন্দ রায় চৌধুরী প্রমুখ। ছাত্র সমাজ ব্যাপকভাবে স্বদেশি আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। 'ছাত্রদের আন্দোলনে অংশ গ্রহণের জন্য অন্যান্য স্কুলের সঙ্গে ফরিদপুরের ঈশান ইন্সটিউিটসহ বৃহত্তর ফরিদপুরের কয়েকটি স্কুলের কর্তৃপক্ষকে কড়া ভাষায় কৈফিয়ত ও মুচলেকা দাবি করা হয়।'
স্বদেশি পটভূমিতে ১৯২৪ সালে ফরিদপুর শহরের টেপাখোলাস্থ খেলার মাঠে বঙ্গীয় কংগ্রেসের সম্বেলন দেশবন্ধু চিত্ত রঞ্জন দাসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী সুভাষ চন্দ বসু, সরোজনী নাইডু, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ যোগ দেন। ওই সম্মেলনে বিদ্রাহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম নিজের লেখা সঙ্গীত পরিবেশন করেন।
বিশ ও ত্রিশ দশকের বৃহত্তর ফরিদপুরের নেতাদের মধ্যে ছিলেন আশু ভরদ্বাজ, সত্য মৈত্র, শান্তি সেন, সমর সিংহ প্রমুখ। যাদের নেতৃত্বে পরবর্তীতে ফরিদপুরে কমিউনিস্ট পার্টির গোড়াপত্তন হয়।
১৯৩০ সালে লবণ সত্যগ্রহ আন্দোলন তীব্র রূপ লাভ করে।ফরিদপুরে প্রায় দুই হাজার লোককে কারারুদ্ধ করা হয়। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন ফরিদপুর শহরের চৌধুরী মোয়াজ্জেম হোসেন লাল মিয়া, রাজবাড়ীর মিসেস চারুপ্রভা সেন, সোনাপুরের নরেশ ঘোষ, প্রভাষ ঘোষ, ক্রোকদীর অনিল লাহিড়ী, অমল স্যানাল, শ্যামেন ভট্টাচার্য, মাদারীপুরের শান্তি সেন, বাহাদুর পুরের পীর বাদশা মিয়া।
ফরিদপুরের বর্তমান আলফাডাঙ্গা, বোয়ালমারী , বালিয়াকান্দিতে তেভাগা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল। যার নেতৃত্বে ছিলেন কমিউনিস্ট নেতা সত্য মৈত্র, শ্যামেন ভট্টাচার্যসহ অন্য নেতারা। শেরে বাংলার নেতৃত্বে গঠিত কৃষক প্রজা পার্টি কৃষকদের সংগঠিত করে জমিদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে আন্দোলন পরিচলনা করে। ফরিদপুরে নেতৃত্বে ছিলেন, পীর বাদশা মিয়া, হুমায়ূন কবীর, জাহাঙ্গীর কবীর, একেএম আব্দুল হাকীম, মোজাহার চোকদার, এমএ ওয়াহিদ প্রমুখ। একসময় মৌলবী তমিজউদ্দিন খান ( এককালীন কংগ্রেস ও পরে মুসলিম লীগ নেতা ) কৃষক সমিতির আন্দোলনে ভূমিকা পালন করেন।
১৯৪২ সালে ফরিদপুর দেউলীতে ফরিদপুর জেলা কৃষক প্রজা পার্টির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় । এতে যোগ দিয়েছিলেন কমরেড এমএন রায়, সৈয়দ নওশের আলী, শামসুদ্দিন আহম্মেদ, হাসেম আলী খান, উপেন্দ নাথ বর্মণ, হুমায়ূন কবীর ও জাহাঙ্গীর কবীর।
ভারত ছাড় আন্দোলনে ১৯৪২ সালে ১৯ সেপ্টেম্বর ভাঙ্গায় মিছিলে বাধা দিলে মিছিলকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। এতে 'রাহিনী বাবু' নামক পুলিশ সাব ইন্সপেক্টর নিহত এবং দুইজন সিপাহী আহত হয়। ওই ঘটনার জের হিসেবে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কিছু স্থানীয় লোককে উস্কানি দিয়ে স্বদেশিদের বাড়ি ও দোকান লুটপাট করায় এবং স্বদেশিদের ১৫ হাজার টাকা জরিমানাও করে। ভারত ছাড় আন্দোলন তত্কালীন ফরিদপুর জেলায় ব্যাপক রূপ লাভ করে। সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় দেড় শতাধিক লোককে গ্রেফতার এবং সুরেষ ব্যানার্জীসহ ৩৩ জনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মেয়াদী শাস্তি প্রদান করা হয়। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ছিলেন ফরিদপুর শহরের টেপাখোলার বিজলী দাস গুপ্ত, থানা রোডের সুনীল চন্দ ব্যানার্জী, পালং এর রায় হারান সেন, মুকসুদপুরের ননী গোপাল ভট্টাচার্য, রাজবাড়ীর নিরোধবন্ধু দাস ও নরেশ চন্দ বসু। আন্দোলনকারীরা ফরিদপুরে দুইটি স্থানের টেলিফোন লাইন বিছিন্ন করে এবং জেলা স্কুলে আগুন লাগিয়ে দেয়। বর্তমান শরীয়তপুরের নড়িয়ায় ড. সুরেষ ব্যানার্জী এমএলএ এর গ্রেফতার প্রতিরোধে নারীরা এগিয়ে গেলে তারা পুলিশের হাতে লাঞ্ছিত হয়।
৪৬ সালে বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখা দিলে ফরিদপুরের কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, কমিউনিস্ট নেতারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে। ৪৬ সালে নোয়াখালী হতে ফেরার পথে গোয়ালন্দ ঘাটে মহাত্মা গান্ধীকে হাজার হাজার জনতা অভ্যর্থনা জানায়।
৪০ এর দশকে হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব বেড়ে যায়। মুসলমানরা কংগ্রেস ও কৃষক প্রজা পার্টি ত্যাগ করে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে মুসলিম লীগের পতাকাতলে শামিল হয়। ফরিদপুরে পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন তমিজউদ্দিন খান, ইউসুফ আলী চৌধুরী মোহন মিয়া, আব্দুস সালাম খান, যুব নেতা শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ।
ফরিদপুরে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্র নির্মাণ করেছিল শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন। শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ফরিদপুরের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। প্রখ্যাত কংগ্রেস নেতা অম্বিকাচরণ মজুমদারের নেতৃত্বে ১৯১৮ সালে রাজেন্দ কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। কলেজটি ফরিদপুরের রাজনৈতিক আন্দোলনের অন্যতম সূতিকাগার।
ইত্তেফাক, ০৫ই আগষ্ট ২০১৩।
No comments:
Post a Comment