জমিদার বাড়ি


বাইশরশি জমিদার বাড়ি-
ফরিদপুরের বাইশরশি জমিদারদের মধ্যে উদ্ধরচন্দ্র সাহা লবণের ব্যবসা করতেন। লবণ বিক্রি করতে যাওয়ার সময় নদীভাঙনকবলিত কোনো এক পড়োবাড়ির ধ্বংসাবশেষ হতে বেশ কিছু গচ্ছিত অর্থ সংগ্রহ করেন। এভাবে অর্থ প্রাপ্তির পর তিনি বাইশরশি বরিশালের কালিয়ায় বিশাল জোতদারি ক্রয় এবং জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন। উদ্ধরচন্দ্র সাহার পুত্র হরেকৃষ্ণ সাহা জমিদারির হাল ধরে বরিশালের বাউফলের জমিদারি কেনেন এবং প্রভূত উন্নতি সাধন করেন। হরেকৃষ্ণ সাহার তিন পুত্রের মধ্যে রাম জয় সাহা জমিদারির ভার নেন। এসময় বাবুরা সাহা উপাধির পরিবর্তে ইংরেজদের কাছ থেকে রায়চৌধুরী উপাধি লাভ করেন। রাম জয় রায়ের দুই পুত্র বৈকুণ্ঠ রায় নীলকণ্ঠ রায় জমিদারি ভাগাভাগি করেন এবং বৈকুণ্ঠ রায়ের অংশকে বড় হিস্সা নীলকণ্ঠ রায়ের অংশকে ছোট হিস্সা বলা হতো। বৈকুণ্ঠ রায়ের কোনো সন্তান না থাকায় তিনি মহিমচন্দ্র রায়কে পোষ্যপুত্র নেন। মহিমচন্দ্র রায় অত্যন্ত প্রতাপশালী ছিলেন। তারও কোনো সন্তান না থাকায় তিনি কলকাতা হতে মহেন্দ্র নারায়ণ রায়চৌধুরীকে পোষ্যপুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। মহিমচন্দ্র রায় বাহাদুর উপাধি লাভ করেন। মহেন্দ্র নারায়ণ রায় বাহাদুর সাধু প্রকৃতির লোক ছিলেন। তিনি তার পোষ্য মাতার মহিমচন্দ্র রায় বাহাদুরের স্ত্রী শিবসুন্দরী চৌধুরানী নামে ১৯১৪ সালে 'বাইশরশি শিবসুন্দরী একাডেমী' প্রতিষ্ঠা করেন। সময় মহেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর বয়স ছিল মাত্র ২০-২২ বছর। নীলকণ্ঠ রায় বাহাদুরের পুত্র রাজেন্দ্র বাবু দেবেন্দ্র বাবু। রাজেন্দ্র বাবুর কোনো সন্তান ছিল না। তিনি রমেশ বাবুকে পোষ্য নেন। দেবেন্দ্র বাবুর ছেলে দক্ষিণারঞ্জন বাবু। দক্ষিণা বাবু রাগী উগ্র প্রকৃতির লোক ছিলেন। দক্ষিণা বাবুর কোনো সন্তান না থাকায় তিনি দিলীপ বাবুকে পোষ্য গ্রহণ করেন। উনিশ শতকের প্রথমদিকে দুই হিস্সার মধ্যে হিংসা-বিবাদের কারণ ঘটায় উভয় হিস্সা মামলা-মোকদ্দমায় জড়িত হয়ে পড়েন এবং তা চূড়ান্ত রূপ ধারণ করলে ফরিদপুর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট উডহেড সাহেবের হস্তক্ষেপে বিবাদের মীমাংসা হয়। অতঃপর দক্ষিণা বাবু তার পিতৃব্য বা জেঠার নামে ফরিদপুরের অম্বিকাচরণ মজুমদার বাবুর সহায়তায় ফরিদপুর শহরে 'রাজেন্দ্র কলেজ' স্থাপন করা হয়। বর্তমান ফরিদপুরের পুরাতন সরকারি হাসপাতালের একটি অংশ এখনো বাবুদের নামে বর্তমান আছে। মহেন্দ্র বাবু নগরকান্দায় নিজের নামে (মহেন্দ্র নারায়ণ একাডেমী) একটি উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপন করেন।
জমিদারদের প্রধান আয়ের উৎস ছিল ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা। খাজনা বা কর আদায় করার জন্য নায়েব নিযুক্ত করা হতো। অবাধ্য প্রজাকে শায়েস্তা করার জন্য লাঠিয়াল বাহিনী ব্যবহার করা হতো। অপরাধ অনুসারে এই প্রজাদের অত্যাচার করা হতো। অত্যাচারের ফলে কারও মৃত্যু হলে মৃতদেহ বাড়ির পেছনে গভীর অন্ধকূপে নিক্ষেপ করা হতো। বাবুদের বাড়ির সামনে দিয়ে জুতা পায়ে, ছাতা মাথায় দিয়ে যাতায়াত নিষেধ ছিল। বাবুদের চারটি পুকুরের মধ্যে নাট মন্দিরের সামনের পুকুরটি পানীয় জলের জন্য রক্ষিত ছিল। ওই পুকুরে কেউ পা ভেজাতে পর্যন্ত পরত না। বেচু নামে এক মুসলমান প্রজা অজ্ঞতাবশত ওই পুকুরে পা ধোয়ার অপরাধে তাকে বেদম প্রহার গোপ-দাড়ি তুলে ফেলা হয়। আর তা নিয়ে মামলা হলেও বাবুদের মাত্র এক পাই জরিমানা হয়। মনিক দহের বড় মিয়া আবদুল বাবুদের বশ্যতা স্বীকার না করার জন্য বাবুরা তার বিরুদ্ধে মামলা করেন। বড় মিয়া আবদুল উপায়ন্তর না দেখে শিবসুন্দরী চৌধুরানীকে মা ডাকেন। পরে শিবসুন্দরী চৌধুরানীর হস্তক্ষেপে বড় মিয়া আবদুলকে মামলা হতে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
বাইশরশি শিবসুন্দরী একাডেমীর বর্তমান খেলার মাঠ বাবুদের চিত্তবিনোদনের জন্য বাগানবাড়ি ছিল। তারা ওই বাগানবাড়িতে খেয়াল-খুশি মত আনন্দ-ফুর্তি করত। জমিদারবাড়িটির আয়োতন ৩০ একরের ঊধর্ে্ব ছিল। ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তি প্রজাস্বত্ব আইন প্রণয়ন হওয়ার পর রমেশবাবু অর্থ এবং বিত্তহীন হয়ে পড়লে জমিদারি হারিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসায় লোকসান বাড়ির দাসী কর্তৃক সঞ্চিত স্বর্ণখণ্ডাদী চুরি হওয়ায় রমেশবাবু নিজে বন্দুকের গুলিতে আত্মহত্যা করেন। এরপর জমিদার পরিবারের সদস্যরা কলকাতা চলে যান এবং অমরেশ বাবু দিনাজপুর চলে যান। এভাবেই বাইশরশি জমিদারদের জমিদারির বিলুপ্তি ঘটে।
জিসান রহমান.


কানাইপুর শিকদার বাড়ী, ফরিদপুর-
ফরিদপুরের জমিদার শাসনের ইতিহাস বেশ সমদ্ধ, এখানকার খ্যাতনামা জমিদার বংশ গুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল কানাইপুরেরশিকদার বংশ। এদেরই বাসস্থানের ধবংসাবশেষ আজ আমরা দেখতে পাইশিকাদাড় বাড়িহিসেবে। জমিদার হিসেবে শিকাদার বংশের উন্নতি শুরু হয় ভবতারিনী শিকদারের আমল থেকে। বিধবা রানী ভবতারিনী তার একমাত্র সন্তান সতীশ চন্দ্র শিকদার এবং অপর এক বিপত্নিক কর্মচারীর সহায্যে তার জমিদারি পরিচালনা করতেন। তবে ভবতারিনীর এই একমাত্র পুত্র সুশাসকের চাইতে উদ্ধত, অহংকারী এবং কুটনৈতিক হিসেবে বেশি পরিচিত ছিলেন। পরবর্তীকালে সতীশ চন্দ্র শিকদারের দুই পুত্র সুরেন্দ্র নাথ শিকদার এবং নিরদবরন শিকদারের মধ্যে জমিদারি ভাগাভাগি হয়ে যায়, এবং সুরেন্দ্র নাথ বড় সন্তান হিসেবে জমিদারীর সিংহভাগ মালিকানা লাভ করে। সুরেন্দ্র নাথের অকাল মত্যুর পরে তার স্ত্রী রাধা রানি শিকদার জমিদারি পরিচালনা করা শুরু করেন। রাধা রানী শিকদারের মত্যুর পর পুত্রদের কোলকাতায় অভিবাসন এবং অর্থনৈতিক ভাঙ্গনের কারণে এক সময়ে এই জমিদারি সরকার বাজেয়াপ্ত করে নেয়।

ফলিয়া জমিদার বাড়ি, আলফাডাঙ্গা, ফরিদপুর-

No comments:

Post a Comment